ওরা বাইরে দাঁড়িয়ে কিন্তু পাহারা দিচ্ছে, সাবধান!

কোটা সংস্কারের দাবিতে রাস্তায় নামল সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। তাদের নির্দিষ্ট কোনো নেতা নেই। কারা সবাই নেতা, সবাই সমন্বয়ক। শুরুতে তো আন্দোলন নিরীহই ছিল। কিন্তু স্বৈরশাসকের ধর্মই হলো, নিরীহ আন্দোলন তার ভালো লাগে না। তার সর্বদা চাই ‘সহমত ভাই’। কিন্তু তারা তো সহমত ভাই গ্রুপ না।

ওরা বাইরে দাঁড়িয়ে কিন্তু পাহারা দিচ্ছে, সাবধান!
ওরা বাইরে দাঁড়িয়ে কিন্তু পাহারা দিচ্ছে, সাবধান!

এসব শিক্ষার্থীকে তো ভুংভাং বুঝ দেওয়া যাবে না। তারা দাবি আদায় না করে ছাড়বে না। জনবিচ্ছিন্ন সরকার উপহাস করল তাদের নিয়ে। শুধু উপহাস নয়, তার ছাত্রসংগঠনকে লেলিয়ে দেওয়া হলো তাদের দমাতে। শক্ত হাতে দমন করতে চাইল ছাত্রলীগ। কিন্তু দমে যায়নি ছাত্রসমাজ। প্রতিরোধ গড়ে তুলল। দম্ভ ভরে এই ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’কে দিয়েছে বলা আওয়ামী সরকার ধারণাও করতে পারেনি কীভাবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ল তাদের ছাত্র সংগঠনের আক্রমণের স্থিরচিত্র, ভিডিও চিত্র। ভয়ানক সেই কোমলমতি শিক্ষার্থীদের মারা দৃশ্য দেখে পরদিন সারা দেশ থেকে যোগ দিল বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসমাজ। বাকিটা ইতিহাস। দুর্বার আন্দোলন, প্রতিরোধ, প্রচুর মৃত্যু, ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া, দেশে কারফিউ জারি করা, বাড়ি বাড়ি গিয়ে ব্লক রেইড দিয়ে ছাত্রদের তুলে আনা, ছাত্র সমন্বয়কদের অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে আন্দোলন প্রত্যাহার আরও কত কী। সব হলো। পৃথিবীর ইতিহাসে কোনো আন্দোলনে এত শহীদ হয়নি।

সরকারি দলের নৃশংস কর্মকাণ্ডে ছাত্রসমাজের মনোবল ভাঙা গেল না। এত অন্যায়-অবিচার মুখ বুজে সয়ে যাওয়া নাগরিক জনতা শামিল হলো এবার। সরকারি ও সরকারি সুবিধাপ্রাপ্ত গুটিকয় লোক বাদে গোটা দেশ ক্যালেন্ডারে জুলাই মাসকে আটকে দিল। যত দিন এক দফা (হাসিনার পদত্যাগ) দাবি পূরণ না হবে, জুলাই মাস ঘরে ফিরবে না। সব কলেজশিক্ষার্থী ঘোষণা দিলেন, অন্যায়ভাবে আটকে রাখা তাঁদের সহপাঠীদের মুক্তি না দিলে তাঁরা পরীক্ষা দেবেন না। জুলাই মাস ৩২-এ পা দিল, তারপর ৩৩, ৩৪, ৩৫ শেষ করে ৩৬-এর সকালে এল আকাঙ্ক্ষিত জয়। স্বৈরশাসক বাধ্য হলেন পদত্যাগ করতে।

শোনা যায়, শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত গুলি চালিয়ে হলেও ক্ষমতায় টিকে থাকতে চেয়েছিলেন তিনি। পারলেন না। পারতে দিল না ছাত্রসমাজ। সবাই তখন রাস্তায়। যাঁরা মিছিল নিয়ে শাহবাগ যাচ্ছেন এই গরমে, তাঁদের রাস্তার পাশের বাসাবাড়ি থেকে নারীরা ঠান্ডা পানির বোতল ছুড়ে মারছে পানি খাওয়ার জন্য। এক অভূতপূর্ব দৃশ্য! শাহবাগ, প্রেসক্লাবে রিকশাচালক ভাড়া নিচ্ছেন না ছাত্রদের পরিবহনে। নিজের চোখে দেখা ফোন করে মালিককে জানাচ্ছে, ‘আজকে স্টুডেন্টদের ডিউটি করতেছি।’ এই যে ধর্ম-বর্ণ-বয়সনির্বিশেষে সবাই এক হয়ে ছাত্র-জনতার আন্দোলন তৈরি করল, তার বিপরীতে আকণ্ঠ দুর্নীতিতে নিমজ্জিত স্বৈরশাসকের জেতার কোনো উপায় কি ছিল? ছিল না। অহংকারী স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার পতনের জন্য গণভবন ঘেরাও কর্মসূচির ভয়ে তিনি পালিয়ে গেলেন দেশ ছেড়ে কোনো রকম বিচারের মুখোমুখি হওয়া ছাড়াই। ছাত্র-জনতার বিজয় অর্জিত হলো। সেদিন বিকেলে শাহবাগ হয়ে উঠল জনসমুদ্র। মাইলের পর মাইল শুধু মানুষ।

কিন্তু বিজয়ের এই গৌরবেও কালিমা লেপে দিল অর্বাচীন কিছু লোকের কাজ। বিজয় উল্লাসের মাত্রা ছাড়াল, যখন ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হলো। গণভবনে উত্তেজিত জনতা ঢুকে লুটপাট করল। ধানমন্ডি ৩২ নম্বরেই বাসা থাকার অপরাধে সংগীতশিল্পী রাহুল আনন্দের বাসা আক্রান্ত হলো। তাঁর পুরো সংগীতজীবনের সংগ্রহ এবং তৈরি করা প্রায় তিন হাজার ইনস্ট্রুমেন্ট ভেঙে ফেলা হলো। রবি ঠাকুরের ভাস্কর্য ভেঙে ফেলা হলো। বীরশ্রেষ্ঠদের ভাস্কর্য ভেঙে ফেলা হলো। এসব বিজয় উল্লাসের অংশ হতে পারে না। এগুলো জিঘাংসা। যারাই এই ঘৃণ্য কাজ করেছে, তাদের নিন্দা ও বিচারের আওতায় আনা জরুরি।

শুধু তা-ই নয়, সারা দেশে সংখ্যালঘুদের জানমালের ওপর আক্রমণ হলো। থানা লুট হলো। থানার গরাদ ভেঙে অপরাধীরা বেরিয়ে গেল। অসাধারণ বিজয়ের আনন্দে এই আক্রোশ কিছুটা হলেও কালিমা লেপে দিল। তবে আশার কথা, সেই রাতেই ছাত্র-জনতা এসব দুষ্কৃতকারীকে প্রতিরোধ করার জন্য মাঠে নেমে পড়ল। পাড়া-মহল্লায় ছোট ছোট বাহিনী নিয়ে মন্দির পাহারা দেওয়া শুরু করল ছাত্র-জনতা। যে সংসদ ভবনে ঢুকে নৈরাজ্য করল অতি উৎসাহী কিছু জনতা, পরদিন ছাত্ররা নেমে পড়ল সেই সংসদ ভবন পরিষ্কারে। গণভবনের লুটপাট হওয়া জিনিস ফিরিয়ে আনা শুরু করল। এ ঘটনা অভূতপূর্ব।

কোনো রাজনৈতিক দল এভাবে দেশ পরিষ্কারে তো এগিয়ে আসেনি? এমনকি এই আন্দোলনের সুবিধাপ্রাপ্ত অন্য সব রাজনৈতিক দলগুলোও তো রাস্তা পরিষ্কার করা, ট্রাফিক কন্ট্রোল করার মতো কাজে নামার ঘোষণা দেয়নি! কারণ, এই ছাত্রসমাজ অনন্য। এই ছাত্রসমাজ আগে দেখেনি বাংলাদেশ। হ্যাশট্যাগ রিফর্ম বাংলাদেশ শুধু ফেসবুকে দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি তারা, বাস্তবে রাস্তায় নেমে করে দেখিয়েছে। এ এক অন্য তরুণসমাজ। তাদের ভয় দেখিয়ে ঘরে ফেরানো যাবে না। তাদের উল্টাপাল্টা বুঝ দিয়ে চুপ করে রাখা যাবে না। তারা দেশের অতন্দ্রপ্রহরী। দেশের ক্ষতি হয়, এমন কোনো কাজ তারা রুখে দেবে। ভবিষ্যতে নির্বাচনের মাধ্যমে রাজনৈতিক যে দলই ক্ষমতায় আসুক না কেন, তাদের মাথায় রাখতে হবে একটা অসাম্প্রদায়িক, সাম্যবাদী, মানবিক রাষ্ট্র গড়ার কারিগরেরা বাইরে দাঁড়িয়ে কিন্তু পাহারা দিচ্ছে। সাবধান!

সংশ্লিষ্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button