- আবদুল লতিফ
অনেক দিন আগের কথা। গ্রামের মানুষ তখন অনেক কষ্টে হেঁটে, রিকশায় চড়ে, বাসে করে ঢাকা শহরে আসা-যাওয়া করত। গ্রামে নদীনালা, খালবিল, পুকুর, ডোবায় প্রচুর মাছ পাওয়া যেত। তখনো মাছ চাষ বা পোলট্রি মুরগির প্রচলন হয়নি। অধিকাংশ গ্রামেই তখনো বিদ্যুৎ পৌঁছায়নি, তাই রেফ্রিজারেটরও ছিল না। গ্রামের মানুষ তাদের শহরে থাকা আত্মীয়স্বজনের বাসায় মাটির হাঁড়িতে করে জিয়ল মাছ, ঘটি ভরে গাভির দুধ এবং দেশি হাঁস-মুরগির পায়ে বেঁধে নিয়ে যেত।
মুনতাহা তার বাবা-মায়ের সঙ্গে ঢাকা শহরে থাকে কিন্তু দাদা-দাদি থাকে গ্রামে। একবার অগ্রহায়ণ মাসে দাদাভাই মাটির হাঁড়িতে করে বিলের জ্যান্ত কৈ ও শিং মাছ, কয়েকটা মুরগি এবং গাভীর খাঁটি দুধ নিয়ে মুনতাহাদের বাসায় বেড়াতে গিয়েছিলেন। বাসায় ঢুকেই মুনতাহাকে ডাকতে ডাকতে দাদাভাই বললেন, দেখ দেখ দাদু তোমার জন্য জ্যান্ত মাছ এবং আরও কতকিছু নিয়ে এসেছি। মুনতাহা দাদাভাইয়ের ডাক শুনে দৌড়ে ছুটে এলো। মুনতাহার মা মাছগুলো যেই ঢালতে শুরু করলেন, অমনি মাছের সঙ্গে আসা একটা রঙিন কোলা ব্যাঙ লাফিয়ে বেরিয়ে আসতেই একটু থতমত খেয়ে উঠলেন। পরক্ষণে মুনতাহাকে বললেন, মামণি দেখো মাছের সঙ্গে কী সুন্দর একটা কোলা ব্যাঙ এসেছে। মুনতাহা ব্যাঙের লাফালাফি দেখে খুব মজা পাচ্ছিল। ব্যাঙটার প্রতি বাসার সবারই মায়া জন্মে গেল। বাসা যেহেতু তিনতলায়, তাই ওপর থেকে ফেললে ব্যাঙটা মরে যেতে পারে, এই ভেবে মুনতাহাকে বললেন, তোমার বাবার সঙ্গে গিয়ে ব্যাঙটাকে ড্রেনে ফেলে দিেেয় এসো তাহলে ব্যাঙটা অন্তত বেঁচে থাকবে। মুনতাহার বাবা ব্যাঙটা একটা পলিথিনে ভরে মুনতাহাকে সঙ্গে নিয়ে গিয়ে বাসার পাশের ড্রেনে ফেলে দিয়ে এলেন। দূর থেকে পানি দেখে ব্যাঙটা খুশিই হয়েছিল কিন্তু যেই ড্রেনের পানিতে ফেলল তার শরীরটা ছেঁত করে উঠল, যেন পুড়ে যাচ্ছে।
গ্রামের ডোবা-নালার মিঠাপানিতে থেকে অভ্যস্ত ব্যাঙটা শহরের ড্রেনের দূষিত পানিটা সহ্য করতে পারছিল না, তাই দ্রুত লাফিয়ে ড্রেনের পাড়ে উঠে গেল। ব্যাঙ উভচর প্রাণী, তাই জলে এবং স্থলে বাস করতে পারে। এভাবেই ব্যাঙের দিন কাটতে লাগল। ধীরে ধীরে শহরের নোংরা দূষিত পানিও অনেকটা গা সওয়া হয়ে উঠল। কিন্তু যখনই গ্রামের সেই ডোবা-নালা আর সঙ্গীদের কথা মনে পড়ত, তখনই তার ভীষণ মন খারাপ হতো আর সব সময় শুধু চিন্তা করত কীভাবে এই শহুরে জীবন থেকে মুক্তি পেয়ে আবার গ্রামে ফিরে যাওয়া যায়।
এক আষাঢ়ে টানা বৃষ্টিতে শহরের ড্রেন উপচে স্রোতের টানে সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। এমন সময় সেই ব্যাঙটা ভেসে চলা এক টুকরো কাঠের ওপরে উঠে বসল। পানির সঙ্গে ভাসতে ভাসতে শহরের কোল ঘেঁষে বয়ে চলা নদীতে গিয়ে পড়ল। নদীর স্রোতে ভাসতে ভাসতে একদিন এক গ্রামে গিয়ে ভিড়ল। চারপাশে আগের আত্মীয় স্বজনদের খুঁজে না পেলেও স্বজাতি ব্যাঙদের দেখে এবং গ্রামের সেই চিরচেনা রূপ ও মিঠাপানির দেখা পেয়ে সে যেন নতুন জীবন পেল। তত দিনে অবশ্য কোলা ব্যাঙ বেশ বুড়ো হয়ে গেছে। অন্য ব্যাঙরা এই বুড়ো ব্যাঙকেও বেশ ভালোভাবেই গ্রহণ করল। সবাই দাদি দাদি বলে ডাকত আর বুড়ো ব্যাঙও বেশ উপভোগ করত।
এক বিকেলে সবাই যখন একসঙ্গে আড্ডায় বসে তখন বুড়ো ব্যাঙ তার জীবনের গল্প বলা শুরু করল। সবাই খুব আগ্রহ ভরে শুনছিল। কেউ একজন বলল, আচ্ছা দাদি তুমি শহর ছেড়ে কেন চলে এলে? আমরা তো শুনেছি ইটপাথরের শহর খুব সুন্দর, খুব মজার। দাদি ব্যাঙ নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ঠিকই শুনেছো তোমরা কিন্তু মানুষ নিজেদের স্বার্থে, নিজেদের আরামণ্ডআয়েশের জন্য শব্দদূষণ, বায়ুদূষণ, পানিদূষণের মাধ্যমে ধীরে ধীরে শহরটাকে নরকের পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছে। শহরে না আছে পর্যাপ্ত গাছপালা না আছে খোলা মাঠ। শহরে থাকা পুকুর এবং খালগুলোও ভরাট
করে গড়ে তুলছে সুউচ্চ দালান-কোঠা। সেখানে ব্যাঙের বসবাস করার উপযুক্ত পরিবেশ নেই। দাদির কথা শুনে শহর এবং শহরের মানুষের প্রতি ব্যাঙরা আগ্রহ ও বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে।