ইসলামী ব্যাংক যেভাবে দখলে নেয় এস আলম গ্রুপ
উপকূল বার্তা ডেস্ক : ব্যাংক খাতের ক্রমাগত দুর্বল হওয়া আর দখলের পেছনে বড় ভূমিকা ছিল খোদ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংকের। গত সরকারের আমলে প্রভাবশালী কয়েকটি ব্যবসায়ী গোষ্ঠীকে সুবিধা দিতে ও তাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক অনেক নীতি-সিদ্ধান্ত নেয়। এর মধ্যে বিশেষ ব্যবস্থায় ঋণ পুনঃতফসিল এবং পুনর্গঠনের সুযোগ, ব্যাংকে পরিবারতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মতো স্পর্শকাতর সিদ্ধান্ত নেয়া অন্যতম। এভাবেই আওয়ামী লীগের শাসনামলে রাজনৈতিক প্রভাবে ইসলামী ব্যাংক সহ একাই ৭টি ব্যাংক দখলে নেয় এস আলম গ্রুপ। খবর:মানবজমিন
এরই মধ্যে কিছু নিয়ন্ত্রণমুক্ত হয়েছে। নিজেদের স্বার্থে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মতো প্রতিষ্ঠানের প্রায় অর্ধশত শীর্ষ কর্মকর্তাকে হাত করেছিল এই গ্রুপটি। এভাবে একেক করে দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে দখলে নেয়ার প্রক্রিয়াকে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এস আলম মডেল। দখলে নেয়া অন্য ব্যাংক হলো- সোশ্যাল ইসলামী, ইউনিয়ন, গ্লোবাল ইসলামী, ন্যাশনাল ব্যাংক ও ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ও কমার্স ব্যাংক।
সংশ্লিষ্টরা জানান, দেশের ব্যাংকিং খাত দীর্ঘ ১৫ বছর ধরেই নানা অনিয়মের কারণে দেশের অর্থনীতি ভঙ্গুর অবস্থায় দাঁড়িয়েছে। ২০১৭ সালের ৫ই জানুয়ারি। ইসলামী ব্যাংকের তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আবদুল মান্নানের সঙ্গে দেখা করতে আসেন একটি গোয়েন্দা সংস্থার শীর্ষ পর্যায়ের কয়েক কর্মকর্তা। জানান, তাকে তাদের সঙ্গে যেতে হবে।
একইভাবে নিজ নিজ বাসা থেকে তুলে নেয়া হয় ব্যাংকটির চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যানকেও। এরপর তাদের জোরপূর্বক পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর করানো হয়, আর ব্যাংকটি দখল করে নেয় চট্টগ্রামভিত্তিক ব্যবসায়ী গোষ্ঠী এস আলম গ্রুপ। শেখ হাসিনার সরকারের উপর মহলের সিদ্ধান্তেই এ উদ্যোগ বাস্তবায়ন করা হয়।
নিয়ন্ত্রণ নেয়ার পর এস আলম গ্রুপ ধীরে ধীরে ব্যাংকটির জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের পদত্যাগে বাধ্য করে ও তাদের নিজস্ব লোক হিসেবে পরিচিত কর্মকর্তাদের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেয়। এস আলম গ্রুপের মালিক সাইফুল আলম পটিয়া অঞ্চলের হওয়ার কারণে ইসলামী ব্যাংকে নিয়োগ পাওয়ার ক্ষেত্রে ওই এলাকার মানুষ বিশেষ সুবিধা পান। এরপর ব্যাংকটি থেকে নামে- বেনামে ও স্বার্থসংশ্লিষ্টদের নামে অন্তত ৫০ হাজার কোটি টাকা লুট করে এস আলম গ্রুপ। ঋণ হিসেবে নেয়া এই অর্থ আর ফেরত না আসায় দীর্ঘ সময় ধরে তারল্য সংকটে ভুগছে দেশের অন্যতম বড় এই ব্যাংক। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত সপ্তাহে আগের পর্ষদ ভেঙে দিয়ে ইসলামী ব্যাংক এস আলমমুক্ত করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকটির চেয়ারম্যান ছিলেন এস আলমের ছেলে আহসানুল আলম।
সূত্র জানায়, ২০১৭ সালের ৫ই জানুয়ারি আরমাডা স্পিনিং মিলের প্রতিনিধি ও সাবেক আমলা আরাস্তু খানকে ইসলামী ব্যাংকের নতুন চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন ব্যাংকের এমডি মো. আবদুল হামিদ মিয়াকে নতুন এমডি হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক একই দিনে এই নিয়োগ অনুমোদন করে। ইসলামী ব্যাংকের সভাটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল রাজধানীর র্যাডিসন ব্লু হোটেলে, বিশেষ নিরাপত্তাব্যবস্থার মধ্যে। আরমাডা স্পিনিং এস আলমেরই স্বার্থসংশ্লিষ্ট একটি প্রতিষ্ঠান।
সূত্রমতে, ২০১৭ সালের ৫ই জানুয়ারি ভোরে পরীবাগের বাসা থেকে ব্যাংকটির তৎকালীন এমডি মোহাম্মদ আবদুল মান্নানকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। একই দিন ভোরে নিজ নিজ বাসা থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় ব্যাংকটির তৎকালীন চেয়ারম্যান মুস্তাফা আনোয়ার ও ভাইস চেয়ারম্যান আজিজুল হককে। তাদেরও একই কার্যালয়ে আটকে রেখে পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর করানো হয়। সেদিনই ব্যাংকটির চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন সরকারের সাবেক সচিব আরাস্তু খান।
ইসলামী ব্যাংকের সাবেক এমডি আব্দুল মান্নান বলেন, ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ নিতে আমাকে বিশেষ মেহমানখানায় নিয়ে গিয়েছিল গোয়েন্দারা। আমাকে যে কাগজে সই নেয়া হয়, তা ইসলামী ব্যাংকের একটি প্যাড। সেই ধরনের প্যাড ১৯৮৩ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ইসলামী ব্যাংক ব্যবহার করেনি। সেই ধরনের প্যাডে আমার পদত্যাগপত্র তারা নিয়েছে। ইসলামী ব্যাংকের মালিকানা দখলে নিতে ২০১৩ সাল থেকে নানা গোষ্ঠী তৎপরতা চালায়। ২০১৬ সালে তা দৃশ্যমান হতে শুরু করলে ২০১৭ সালের ৫ই জানুয়ারি ব্যাংকটির পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনায় হঠাৎ পরিবর্তন ঘটে। আব্দুল মান্নান বলেন, ওই দিন অনেক রাত পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের স্যারেরা অফিস করেছেন। তারা ওই দিনই ব্যাংকের মালিকানা পরিবর্তনের কাজটি দ্রুত সম্পন্ন করতে কাজ করেছেন। ব্যাংক কোম্পানি আইন নতুন করে তৈরি করার পরামর্শ দিয়ে আব্দুল মান্নান বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকে যে ভূত আছে তা সরিষার মধ্যে ভূত। এখন প্রয়োজন বাংলাদেশ ব্যাংককে মেরামত করা। তাদের স্বাধীন করতে হবে। এখন অরাজনৈতিক সরকার থাকায় ব্যাংক খাত সংস্কারের সুবর্ণ সুযোগ উল্লেখ করে তিনি বলেন, জনগণের সম্পদ এখন চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ ও ঢাকার মতিঝিলে। সব সম্পদ এখানেই পুঞ্জীভূত হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংককে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিতে হবে।
এস আলম গ্রুপ নিয়ন্ত্রণ নেয়ার আগে ইসলামী ব্যাংকের ৫০ শতাংশের বেশি মালিকানা বিদেশিদের হাতে ছিল। এখন যা কমে ১৩ শতাংশে নেমেছে। ২০১৭ সালে এস আলম গ্রুপ যখন ব্যাংকটির নিয়ন্ত্রণ নেয়, তখন ব্যাংকটিতে তাদের তিন প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ ছিল ৩ হাজার ৬ কোটি টাকা। প্রাপ্ত নথিপত্র পর্যালোচনায় দেখা গেছে, এস আলম নাম যুক্ত আছে ও নাম যুক্ত নেই- এমন ঋণের পরিমাণ এখন প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা। ইসলামী ব্যাংকের ‘বৈষম্যবিরোধী ও ব্যাংকের স্বার্থ রক্ষাকারী ব্যাংকার সমাজের’ সমন্বয়ক আবু ওয়ালিদ চৌধুরী সম্প্রতি এক বিবৃতিতে বলেন, ব্যাংক থেকে নামে-বেনামে ৬৫ হাজার কোটি টাকা বের করে নিয়েছে এস আলম গ্রুপ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলেন, ফজলে কবির ও আব্দুর রউফ তালুকদার গভর্নরের দায়িত্ব পাওয়ার পর ব্যাংক খাতের অবস্থা আরও ভঙ্গুর হয়েছে। ২০২২ সালের জুলাইয়ে গভর্নরের দায়িত্ব পান সাবেক সচিব আব্দুর রউফ তালুকদার। সব ধরনের নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে কয়েকটি শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকের চলতি হিসাবে প্রায় ২৯ হাজার কোটি টাকা ঘাটতি রেখে লেনদেনের সুযোগ করে দেন তিনি। অর্থ পাচারের সুনির্দিষ্ট তথ্য জেনেও তিনি ব্যবস্থা নেননি। এ রকম পরিস্থিতির মধ্যে নতুন সরকারে গভর্নরের দায়িত্ব পেয়েছেন ড. আহসান এইচ মনসুর।
এস আলম মডেল: ৭টি ব্যাংক দখল নিয়ে ব্যাংকার মামুন রশীদ বলেন, এখন ব্যাংক খাতে এস আলম মডেল দাঁড়িয়েছে। তারা ব্যাংকটি দখল করে নিয়েছে গান পয়েন্টে, সব পরিচালকদের পদত্যাগে বাধ্য করে একটি পাঁচ তারকা হোটেলে। এক রাতের মধ্যেই সুপারসনিক গতিতে নতুন এমডি নিয়োগ অনুমোদন দিলো বাংলাদেশ ব্যাংক। এসব কিছুই হয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বাইরে থেকে উপরের নির্দেশে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আনুকূল্য ছিল ব্যাংকটি দখলে। এস আলম গ্রুপ ব্যাংকগুলো থেকে যে টাকা নিয়েছে তা পাচারের দায়িত্ব ছিল বাংলাদেশ ব্যাংকের তৎকালীন ডেপুটি গভর্নর ও পরে উপদেষ্টা হওয়া এস কে সুর চৌধুরীর (সিতাংশু কুমার সুর চৌধুরী)। তার (এস কে সুর) ব্যাপারে তৎকালীন অ্যাটর্নি জেনারেলও কথা বলেছিলেন, তারপরেও কিছু হয়নি। তার দায়িত্ব ছিল এস আলম গ্রুপের ব্যাংকগুলো থেকে নেয়া টাকা পাচার করে দেয়া।